প্রদীপ সরকার

প্রদীপ সরকার
আইসক্রিমের কাঠি আমার সাফল্যের চাবিকাঠি
বাবা-মা ও ছোট বোনকে নিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার। ছয় বছর হলো বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট বোন শম্পা উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছে। নিজেদের জায়গা-জমি বলতে গেলে কম নেই। সাত-আট বিঘা হবে। তার পরও সংসার ভালোভাবে চলে না। অভাব লেগেই থাকত। আমাদের এলাকাটা নিচু। বর্ষায় মাঠ-ঘাট তলিয়ে যায়। মাঠে ফসল হয় না। বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করি আর পাশাপাশি পড়ালেখা। কোনো দিন স্কুলে যাই, আবার কোনো দিন স্কুলে যাওয়া হয় না।

১০-১১ বছর আগে বাবা ভারতে এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যান। সেখানে গিয়ে আইসক্রিমের কাঠি তৈরির একটি কারখানা দেখেন। খোঁজ নেন কারখানাটি করতে কত খরচ পড়েছে, লাভ কেমন। ঘর থাকলে কারখানা করতে পাঁচ-ছয় লাখ টাকার মতো লাগে। বাবা বাড়ি ফিরে মা ও আমাকে এসব বললেন। সংসারের অভাব ঘোচাতে আইসক্রিমের কাঠি তৈরির একটি কারখানা করার কথা ভাবি। কিন্তু টাকার অভাবে ওই যাত্রায় আর কারখানা করা হয়ে ওঠেনি। তবে চিন্তাটা মাথায় রয়ে যায়।
২০০৫ সালের কথা। স্থানীয় স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছি। ভর্তি হলাম সিংড়া বিহারীলাল কলেজে। মাঠের কাজ আর কলেজের ক্লাস—সবকিছুর মধ্যে ওই কারখানা গড়ার স্বপ্ন উঁকি দিত। এইচএসসি পাস করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিতে থাকলাম। কিন্তু কোথাও সুযোগ পেলাম না। বাবাকে বললাম, এ বছর হলো না, আগামী বছর ভর্তি হব। এ সময়ে যেকোনোভাবেই হোক টাকা জোগাড় করে আইসক্রিমের কাঠি তৈরির কারখানা করতে হবে। কিছু জমি বন্ধক রেখে পেলাম এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা, আশা এনজিও থেকে ৭৫ হাজার, কৃষি ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার, জনতা ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার টাকা এভাবে নানা জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করলাম। ভারতের তৈরি কাঠি কাটা, পাতা তোলা, ফিনিশিং মেশিন, মেশিন চালানোর জন্য তিনটি ডিজেল ইঞ্জিন কিনে আনলাম। রাস্তার পাশে নিজেদের জায়গায় বড় করে কারখানার জন্য ঘর তুললাম। এভাবে একটা একটা করে প্রায় দুই বছর ধরে ২০০৭ সালের শেষ দিকে কারখানার কাজ শেষ হলো। তিনজন শ্রমিক আর বাবা, মা, বোনকে নিয়ে পরের বছর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎপাদন শুরু করি।
আইসক্রিমের কাঠি তৈরিতে নরম জাতের সাধারণ কাঠ যেমন লাটিম, ভেটুল, কদম, আমড়া, ছাতিমজাতীয় কাঠ লাগে। এসব কাঠের দামও খুব কম। প্রথম দিকে আমি আর বাবা গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাঠ কিনে আনতাম। এখন কাঠ ব্যবসায়ীরা কারখানায় কাঠ পৌঁছে দেন। এক ঘনফুট (সিএফটি) কাঠের দাম ১৬০-১৭০ টাকা। প্রতিদিন কারখানায় ৩৫-৪০ সিএফটি কাঠ লাগে। ডিজেল লাগে ১৬-১৮ লিটার। কারখানায় দুই রকম কাঠি তৈরি হয়। ছোট ও বড়। ছোট কাঠি ২৫-৩০ টাকা বান্ডিল (এক বান্ডিলে এক হাজার কাঠি থাকে)। বড় কাঠি ৩০-৩৫ টাকা বিক্রি হয়। কাঠি বিক্রির বড় মোকাম ঢাকার যাত্রাবাড়ী। এ ছাড়া মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ীতেও কাঠি বিক্রি হয়। আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মালিকেরা কাঠি কিনে নিয়ে যান। ঢাকায় না গিয়েও মহাজনদের কাছে কাঠি পাঠালে তাঁরা বিক্রি করে টাকা পাঠিয়ে দেন। কাঠি তৈরি করার প্রক্রিয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি বের হয়। এ ছাড়া কাঠি বান্ডিল করার সময়ও প্রচুর কাঠি বাছাইয়ে বাদ পড়ে। এগুলো স্থানীয়ভাবে জ্বালানির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কারখানা থেকে কম দামে এগুলো বিক্রি করা হয়।
আমাদের তালখড়ি ও আশপাশের গ্রামের মানুষ খুব অভাবী। বেশির ভাগ মানুষ গরিব, দিনমজুর, ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষি। নিচু এলাকা হওয়ায় বর্ষায় মাঠ-ঘাট এমনকি বাড়িঘর পর্যন্ত তলিয়ে যায়। পানি নামার পথ না থাকায় জলাবদ্ধতা অনেক দিন স্থায়ী হয়। মাঠে ফসল ফলে না। এ সময় নারী-পুরুষ কারও কোনো কাজ থাকে না। বিশেষ করে নারীরা একেবারেই অলস সময় কাটান। আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী। নারীদের কাজের বাইরে রেখে সমাজ বা দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি অসম্ভব। এ জন্য আমি কাঠি বাঁধার কাজে কেবল নারীদের সম্পৃক্ত করেছি। তাঁদের স্বাবলম্বী ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছি। তাঁরা সংসারের কাজের ফাঁকে অবসরে কাঠি বাঁধার কাজ করেন। স্কুল থেকে এসে শিশুরাও কাঠি বাঁধে। তাদের আয়ে তারা পড়ার খরচ চালায়। এমন বহু পরিবার আছে, যাদের কাঠি বাঁধার টাকা দিয়ে জীবন-জীবিকা চলে। দুই বেলা দুই মুঠো ভাত খাচ্ছে। শিশুরা পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছে। অনেকে কাঠি বাঁধার টাকা জমিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। অভাব যাঁদের নিত্যসঙ্গী ছিল, তাঁরা ধীরে ধীরে সচ্ছল হয়ে উঠছেন। আমি এখন বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, মাত্র চার বছরে আমার কারখানায় কাঠি বাঁধার কাজ করে এখানকার অসচ্ছল মানুষগুলো এখন সচ্ছল হয়েছেন। কেউ আর না খেয়ে থাকেন না। এ কথা ভাবতেই গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে।
কাঠি বাঁধার জন্য ৬৫ জন তালিকাভুক্ত নারী রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত কাঠি বাঁধেন। গরমের মৌসুমে এ সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। এসব নারীর সঙ্গে তাঁদের পরিবারের অন্য নারী-শিশু ও বৃদ্ধরাও কাজ করেন। অসচ্ছলদের পাশাপাশি সচ্ছল নারীরাও অবসরে কাঠি বেঁধে বাড়তি আয় করছেন। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ জন কাঠি বাঁধেন। এক হাজার কাঠি একত্র করে গুছিয়ে বাঁধতে পাঁচ-সাত মিনিট সময় লাগে। এ জন্য পারিশ্রমিক দেওয়া হয় এক টাকা। একজন নারী গড়ে প্রতি মাসে সংসারের কাজের ফাঁকে কাঠি বেঁধে ন্যূনতম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় করেন। শীতের মৌসুমে নারী-শিশুরা মহানন্দে উৎসবের আমেজে প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ আঁটি বা বান্ডিল বাঁধতে পারে। মাস শেষে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। গ্রামের প্রতিটি ঘরে বান্ডিল বাঁধার জন্য বিশাল বিশাল স্তূপ করে কাঠি রাখা হয়। কারখানা থেকে শ্রমিক দিয়ে বাড়ি বাড়ি ওই কাঠি পৌঁছে দেওয়া হয়। কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ মাসে বাজারে কাঠির চাহিদা কম থাকে। তার পরও বছরের ৩৬৫ দিনই কাঠি বাঁধার কাজ চলে। শীতের সময় উৎপাদিত কাঠি মজুত করে রাখা হয়। কারখানায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধকোটি পিস কাঠি তৈরি হয়।
কাঠি তৈরির কারখানা করে আমার জীবন-জগৎ পাল্টে গেছে। সবাই প্রশংসা করেন। উৎসাহ দেন। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তবে মানুষের কল্যাণে কিছু একটা করতে পেরেছি বলে শান্তি পাই। সব কষ্ট ভুলে যাই। মাগুরা সরকারি হোসেন শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দী কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ছি। এখন তৃতীয় বর্ষে। ক্লাস বা প্রাইভেট পড়া থাকলে সকালে ঘুম থেকে উঠে কলেজে যাই। কারখানা ছাড়াও খেত-খামার করি। তাই কলেজ থেকে ফিরে মাঠে বা কারখানায় কাজে নেমে পড়ি। প্রতিদিন রাত তিনটার দিকে উঠে কারখানার মেশিন চালাই। দিনের চেয়ে রাতে কারখানায় কাজ করা সুবিধা। কাঠ থেকে মেশিনে রোল করা, কাঠি কাটা, ফিনিশিং আরও অনেক কাজ। নিজে না থাকলে কর্মচারীদের দিয়ে কাজ হয় না। নয়জন কর্মচারী আছেন। পেরে উঠছি না। তাই ভাবছি আরও কয়েকজনকে নিয়োগ দেব। তবে অবশ্যই তাঁরা হবেন এলাকার বেকার যুবক।
আসলে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকা, সুখে থাকার আনন্দই আলাদা। একা ভালো থেকে কোনো লাভ নেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিকা নিয়ে একটু একটু করে সমাজকে পাল্টাতে হবে। কথা বলা, বসে থাকার সময় নেই। কাজ করতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমার গর্বে বুক ভরে যায় যখন ভাবি, আমি খুবই ক্ষুদ্র একটা মানুষ, তার পরও কিছুটা হলেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। খুব গভীরভাবে যখন ভাবি, চোখে জল চলে আসে। যাঁদের দুই বেলা দুই মুঠো খাবার জুটত না, তাঁরা আমার কারখানায় কাজ করে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে। এই সুখানুভূতি বোঝাতে পারব না।
দারিদ্র্য কী আমি জানি। পরিশ্রম আমাকে এখানে এনেছে। তাই আমি কারখানার লাভের দিকে বেশি না তাকিয়ে কারখানায় যাঁরা কাঠি বাঁধার কাজ করেন, তাঁদের মুখের দিকে তাকাই। আমি সততার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। সফল হবই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দারিদ্র্যপীড়িত এ অঞ্চলকে আমি একদিন বদলে দেব।
সত্যি কথা বলতে কি, আমার এ স্বপ্নযাত্রায় সঙ্গী প্রথম আলো। আমার কারখানা নিয়ে প্রথম আলোয় এ বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর আমার জীবন-জগৎ পাল্টে গেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসেছেন। পরামর্শ নিচ্ছেন। মাগুরার বাইরে কয়েক জায়গায় গিয়েছি পরামর্শ দিতে। এলাকার মানুষও কারখানা করার কথা ভাবছেন। এতে আমার কোনো ঈর্ষা নেই। আমি সানন্দে সবাইকে পরামর্শ দিই। সবাই হাত না লাগালে দেশ উঠবে না। ভাবতে পারিনি প্রথম আলোর প্রতিবেদন এমন সাড়া ফেলবে।
প্রথম আলোর কাছে আমি ঋণী। মানুষ নিরাশা বা হতাশার খবর শুনতে শুনতে অস্থির। প্রথম আলোর এমন উদ্যোগ মানুষকে আশাবাদী করবে। প্রথম আলো আমার আত্মবিশ্বাস কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, এমন খবর পড়ে অনেকে স্বপ্ন দেখবেন, স্বপ্ন গড়বেন। কেউ কেউ সফলও হবেন। প্রথম আলোর কাছে আমার প্রত্যাশা, দেশের আনাচকানাচে যাঁরা আমার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়েছেন, কাজ করছেন, খুঁজে বের করে তাঁদের কথা পত্রিকার পাতায় তুলে ধরবে। আমরা একদিন সফল হবই। এ দেশ পিছিয়ে থাকবে না। মানুষ বদলে যাবে। আমরাই দেশকে বদলে দেব।
 অনুলিখিত

নিলুফার ইয়াসমিন

নিলুফার ইয়াসমিন
বিন্না থেকে কানাডা
২৮ বছর আগে নাজিরপুর উপজেলার কলার দোয়ানিয়া এলাকা থেকে স্বরূপকাঠি উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের বিন্না গ্রামে বউ হয়ে আসি। বিয়ের এক বছর পর আমার স্বামী আবুল কালাম আমাকে বিন্না গ্রামের বাড়িতে রেখে কাজের খোঁজে ঢাকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে স্টেডিয়াম এলাকায় একটি ক্যারম বোর্ড, শিল্ড তৈরি কারখানায় (দোকানের নাম খেলার সাথী) কাজ নেন। যেখানে জুটত তিন বেলা খাবার আর মাস শেষে ১০০ টাকা ও থাকার ব্যবস্থা। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে এসে আমার স্বামী বলতেন তাঁর দুরবস্থার কথা। সব সময় চিন্তা করতেন, ‘অভাবী পরিবার আমাদের, সামনে কীভাবে আমরা চলব।’

সময় গড়াতে থাকে, এরই মাঝে আমাদের সংসারে দুই সন্তান আসে। ওই কারখানায় কয়েক বছর কাজ করার পর আমার স্বামী আবুল কালামের বেতন ৫০০ টাকা দাঁড়ায়। কারখানায় কাজ করার সময় একদিন পাশের দোকানে একটি ক্রিকেট ব্যাট দেখেন আমার স্বামী। স্থানীয় কাঠ দিয়ে সে রকম একটি ব্যাট তৈরি করে ফেলেন তিনি। কারখানার মালিক আমার স্বামীকে এ ব্যাটের আদলে কয়েকটি ব্যাট তৈরি করে দিতে বললে তিনি স্থানীয় কাঠ দিয়ে প্রায় ৮০টি ব্যাট তৈরি করে ফেলেন।
২১ বছর আগের কথা। আমার স্বামী একদিন ঢাকা থেকে বাড়িতে এসে আমাকে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কথা জানান, আমি তখন তাঁকে বলি এখন তো ৫০০ টাকা পাও, ব্যাট তৈরি করতে গিয়ে সবকিছু যেন খোয়া না যায়। কাজপাগল আমার স্বামী আমাদের বাগানে থাকা নারকেল-সুপারি বিক্রি করে সাত হাজার টাকা সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন লোকের বাগান থেকে কদম, চাম্বল, মেহগনিসহ বিভিন্ন কাঠ কিনে আনেন। এরপর এ কাঠগুলো মিল থেকে চেরাই করে আনেন। সঙ্গে কাঠ ছাঁচা-মাটার জন্য রানদা, হাতুড়ি, বাটাল, কুঠার ও আইকা গাম কিনে আনেন।
আমরা দুজন মিলে কাঠগুলো কুঠার দিয়ে কুপিয়ে সাইজ করে রানদা দিয়ে ছাঁচি এবং বাড়ির উঠানে রোদে কাঠগুলো শুকাতে দিই। প্রায় এক মাস ধরে এ কাঠগুলো শুকানোর পর প্রতিটির ‘ভি’ কাটি (যেখানে হাতল জোড়া লাগানো হয়)। হাতল জোড়া দেওয়ার পর ওপর ও নিচের অংশ কেটে ফেলি। এরপর কুঠার দিয়ে আস্তে আস্তে কোপাই এবং সবশেষে রানদা দিই ও হাতলের জোড়া মুখে ফাইল ঘষি।
কাঠ শুকানোর এক মাস পর সেই কাঠে একটি ব্যাট তৈরি করতে ১৫ মিনিট সময় লাগে। একটি ব্যাট তৈরিতে নয় বার হাত লাগাতে হয়। আমরা দুজনে মিলে ৮০০ ব্যাট তৈরি করে প্রথম চালান ঢাকায় পাঠাই। শূন্য থেকে বড় সাইজের এ ব্যাটগুলো ঢাকায় পাইকারি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা পাই। খরচ বাদ দিয়ে প্রথম দফায় আমাদের লাভ হয় ৩০ হাজার টাকা। আমাদের তৈরি করা ব্যাটের চাহিদা বাড়ার পর আমাদের কারখানায় ধীরে ধীরে লোকবল বাড়াই। যা একসময় ১৫-১৬ জনে দাঁড়ায় এবং ব্যাট তৈরির কাজের জন্য কিছু স্থায়ী মেশিনপত্র কিনি।
২০০১ সালের দিকে ঢাকার মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে দেওয়া ক্রিকেট ব্যাটের দাম বাকি পড়ার কারণে আমাদের পুঁজির সংকট দেখা দেয়। এ সময় ‘পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র’ নামে একটি এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ নিই। ২০০৫ সালের দিকে আমি সফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে সিটি গ্রুপ পুরস্কার লাভ করি এবং ঢাকার হোটেল শেরাটনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণ করি। এ সময় প্রথম আলো থেকে একটি মোবাইল ফোন ও এক হাজার টাকা এবং চ্যানেল আই থেকে তিন হাজার টাকা ও একটি টাঙ্গাইলের শাড়ি আমাকে দেওয়া হয়।
প্রথম আলোতে আমাদের তৈরি ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর আমাদের বাড়িতে সাংবাদিকদের আসা-যাওয়া বেড়ে যায়। আমাদের তৈরি ব্যাটের চাহিদা দেখে আমাদের গ্রাম বিন্নাসহ নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে প্রায় ২০০ কারখানা গড়ে উঠেছে। ২০০০ সালে আমি সিটি গ্রুপের সহায়তায় কানাডার হেলিফ্যাক্স শহর ঘুরে এসেছি। সেখানে আমাদের সঙ্গে নোবেল বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ইউনূস স্যারও ছিলেন। বিন্না গ্রামের বাড়ি থেকে স্বরূপকাঠি উপজেলা সদরেও খুব বেশি যাওয়া হয়নি। আর মেয়ে একবার অসুস্থ হওয়ার কারণে ঢাকা গিয়েছিলাম তাকে ডাক্তার দেখাতে, আমার স্বামী যখন ঢাকায় কাজ করত। ছেলে রিয়াদুল ইসলাম বর্তমানে আলাদা কারখানা গড়ে তুলেছে আর মেয়ে লাইলীকে বিয়ে দিয়ে জামাইকেও ব্যাট তৈরির কাজ শিখিয়ে দিয়েছি।
বিদেশে যাব, প্লেনে চড়তে হবে, ভয়ে ছিলাম যদি প্লেনে উঠতে গেলে পড়ে যাই! অবশ্য প্লেন থেকে পড়ে যাইনি, সুস্থভাবেই কানাডা থেকে ফিরে এসেছি। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে প্রথম আলোর লেখার কারণে। আমাদের কারখানাও সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আজ আমি সফল ব্যবসায়ী। অভাব দূরে সরে গেছে। নিজেদের আয় থেকে আট কাঠা জমি কিনেছি, তাতে একটি ঘরও তৈরি করেছি। প্রথম আলো আরও সামনে এগোবে, আর আমার মতো অজ পাড়াগাঁয়ের এ রকম নিলুফার ইয়াসমিনদের সাফল্যের কথা পত্রিকার মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে ধরবে, এ আশা আমার।
 অনুলিখিত

আবদুর রহিম

চাই সদিচ্ছা আর পরিশ্রম
আবদুর রহিম
১৯৯৪ সালের কথা। ওই বছর বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময় ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে টিভি মেরামতের কাজে খুব ব্যাঘাত ঘটে। এই সময় আমার মাথায় ঘুরপাক খায় বিকল্প পন্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি। শেষ পর্যন্ত আমি আইপিএস বানানোর চেষ্টায় কাজ শুরু করি। ঢাকা, বরিশাল ও কলকাতা থেকে এ-বিষয়ক কারিগরি নানা ধরনের বইপত্র এনে বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটতে থাকি। দিন-রাত এ কাজে সময় দিয়ে আমার মেকানিকের কাজ লাটে ওঠে। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাল কেনার মতো ক্ষমতাও ছিল না।

এরই মধ্যে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে ধার-দেনা ও সুদে অনেক টাকা এনে পরীক্ষামূলক আইপিএস বানানোর কাজে তা ব্যয় করি। ধার-দেনায় জড়িয়ে আমার নিঃশেষ হওয়ার অবস্থা। তবু এই নেশা আমার যায় না। একদিন আমার স্ত্রী একমাত্র সন্তানকে নিয়ে রাগে-দুঃখে আমাকে ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যায়। আমি তখন আরও অসহায় হয়ে পড়ি। কিন্তু নেশাটা আমায় ছাড়ে না। এভাবে নয় মাস চেষ্টার পর একটা আইপিএস বানিয়েও ফেলি। কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি। আবার চেষ্টা করি, আবার ব্যর্থ হই—এভাবে করতে করতে দুই বছর পর আমার চেষ্টা কিছুটা সার্থক হয়। সাত বছর চেষ্টার পর তা আরও পূর্ণতা পায় এবং ২০০১ সালে প্রথম বাজারে পরীক্ষামূলক দুটি আইপিএস বিক্রি করি। আর এখন আমার প্রযুক্তির আইপিএস দেশের সর্বত্র বাজারজাত হচ্ছে। দেশের বাজারে বর্তমানে সবচেয়ে কম মূল্যে বিক্রি হচ্ছে এবং সবচেয়ে বেশি সময় ব্যাকআপ (চার ঘণ্টা) দিচ্ছে।
আমি ছিলাম সাধারণ এক রেডিও-টিভি মেকানিক। বরগুনায় বাড়ি। মক্তবে লেখাপড়ার পর সংসারের হাল ধরতে হয় আমার। তাই আর লেখাপড়া করতে পারিনি। কিন্তু আমি দমে যাইনি। নতুন কিছু একটা করার চেষ্টা ছিল সব সময়। তরুণদের উদ্ভাবনী ক্ষমতায় আমার বিশ্বাস আছে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। আমার তৈরি আইপিএসের গুণগত মান উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি। যাঁরা আমার আইপিএস ব্যবহার করেন, তাঁদের কম্পিউটার চালাতে আলাদা ইউপিএস দরকার হয় না। সম্প্রতি আমার আইপিএসে যোগ করা হয়েছে সোলার প্রযুক্তি। নিম্ন আয়ের মানুষেরা যাতে বিদ্যুতের সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা মূল্যের সোলার-সংবলিত আইপিএস তৈরি করেছি। এখন বিদ্যুৎ নেই এমন গ্রামেও উদ্ভাবিত এই আইপিএস ব্যবহার করা যাচ্ছে।
২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম আলো আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য ব্যক্তি ফোন করে আমার কাজের প্রশংসা করেন। প্রথম আলো আমাকে দেশে এমনকি বিদেশেও পরিচয় করিয়ে দেয়। ওই খবর আমার কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দেয়, পাশাপাশি ঘুরিয়ে দেয় জীবনের মোড়।
আমি লেখাপড়া জানি না, কিন্তু মানুষ আমাকে ভালোবাসে, সম্মান দেয়; এর চেয়ে জীবনে বড় পাওয়া আর কী থাকতে পারে। তবে অর্থ আর সম্মানের আশায় আমি কাজ করি না। এই দেশটাকে আলোকিত করাই হলো আমার স্বপ্ন। আমাদের শ্রমশক্তি ও বুদ্ধি আছে। এখন বিদ্যুতের অভাব দূর করা গেলে এই দেশের অগ্রগতি কেউ ঠেকাতে পারবে না।
দিন-রাত খাটাখাটুনির মধ্যেও কেবল ভাবি, কীভাবে আমার এই প্রযুক্তি আরও উন্নত করা যায়। কারণ, প্রযুক্তি বিষয়টা এমন যে এটা দিন দিন সামনে এগিয়ে যায়। আমার শুধু চিন্তা হয়, এটুকু করে যদি আমি বসে থাকি তবে পেছনে পড়ে যাব। এই চিন্তাটা আগে আমার হতো না, প্রথম আলো আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশ-বিদেশ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়ে এই সংশয়টা আমাকে তাড়া করতে থাকে। কারণ, নিজেই জানতাম না আমি কী কাজ করেছি। প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ অনেক প্রকৌশলী প্রথম আলোর প্রতিবেদন পড়ে আমার বানানো আইপিএস ও এর সার্কিট পরীক্ষা চালিয়ে বললেন, এটা আসলেই সেরা। তখন থেকেই এই চিন্তাটা আমাকে আরও বেশি করে চেপে ধরে।
দেশের বাজারে যে আইপিএস পাওয়া যায়, সেগুলো দুই ঘণ্টার বেশি ব্যাকআপ দেয় না। দেশে-বিদেশে তৈরি ১০০০ ভিএ (ভোল্ট-অ্যাম্পিয়ার) ক্ষমতাসম্পন্ন একটি আইপিএসে যেখানে ১২ ভোল্টের দুটি ব্যাটারি লাগে, সেখানে আমার আইপিএসে ব্যাটারি লাগে মাত্র একটি। কিন্তু অন্যরাও হয়তো একটা ব্যাটারি ও চার ঘণ্টা ব্যাকআপ দেয় এমন আইপিএস বানিয়ে ফেলবে, সেদিন বেশি দূরে নয়। তখন আমার আইপিএসের তো কোনো বিশেষ গুণ থাকবে না। সেই চিন্তা আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। দুই বছর ধরে ভেবে এখন অবশ্য একটা বুদ্ধি বের করে ফেলেছি। বুদ্ধিটা হলো আইপিএসের সঙ্গে সোলার প্যানেল সংযোজন। এরই মধ্যে বরগুনার কয়েকটি গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে ২০টির মতো আইপিএসে সোলার প্যানেল সংযোজন করে দিয়েছি এবং তারা সার্বক্ষণিক সূর্যের আলো দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারছে। এতে যেমন ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার কোনো চিন্তা নেই, তেমনি ব্যাকআপ নিয়েও দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
সোলার প্যানেল দিয়ে যেখানে শুধু অল্প আলোর কয়েকটা বাতি ছাড়া অন্য কোনো কিছু চালানো যেত না, এখন তাতে ফ্যান, রঙিন টিভি, ছোট্ট মোটর, কম্পিউটার, ড্রিল মেশিন, প্রিন্টার চালানো যাচ্ছে। গ্রামের মানুষেরা এটা দিয়ে কম্পিউটার চালিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।
গরিব মানুষের তো আইপিএস ব্যবহারের সুযোগ নেই। এসব বিবেচনায় এনে সম্প্রতি মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় সোলার প্যানেল সংযোজিত একটি আইপিএস বাজারজাত করেছি। এতে চার ঘণ্টা অনায়াসে চারটি বাতি জ্বলবে। এক হাজার ৫০০ টাকায় দুটি বাতি জ্বলবে এমন আরেকটি আইপিএসও বাজারে ছেড়েছি। এর ফলে প্রত্যন্ত গ্রামেও সহজে এই আইপিএস ব্যবহার করা যাবে। সূর্যের আলো ব্যবহার করে আইপিএস চালাতে পারলে এবং কম দামে তা দিতে পারলে মানুষের অনেক উপকারে আসবে। এটা ব্যাপক হারে করতে পারলে গ্রামের মানুষ নিজস্ব আলো ব্যবহার করে আলোকিত হতে পারবে।
২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে বরগুনার বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায় এক মাস বিচ্ছিন্ন ছিল। তখন দেশ-বিদেশের সব ধরনের খবরাখবর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এ জেলার মানুষ। ওই সময় শহরের সিদ্দিক স্মৃতিমঞ্চে বড় পর্দা লাগিয়ে আইপিএস দিয়ে প্রতিদিন রাতে টিভি দেখানোর ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখেছি খবরের জন্য মানুষের কী ব্যাকুলতা। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দলে দলে খবর দেখতে এখানে ভিড় করত। এখনো সামান্য ঝড়-বৃষ্টি হলে বরগুনার নাজুক বিদ্যুৎ সরবরাহ দু-তিন দিন বিচ্ছিন্ন থাকে। তখন মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। কিন্তু এখন এই দুর্ভোগ অনেক ঘুচিয়ে দিয়েছে আইপিএস। মানুষের এই দুর্ভোগ লাঘবে আমার মতো সামান্য একজন মানুষের প্রচেষ্টা কাজে লাগবে, এটা কখনো ভাবিনি।
বর্তমানে আমার কারখানায় ও বাজারজাতের কাজে ৭০-৭৫ জন লোক কাজ করে। ছয়-সাত বছর আগে যা শুরু করেছিলাম আমি একাই। কারখানায় আমার যেসব সহকর্মী, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা মালিক-শ্রমিকের নয়। আমি এখনো ওদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি। কারণ, কারখানাটা আমার সন্তানের মতো। আর কাজ হলো আমার পরম ইবাদত। আমি জানি, কাজের লোকেরা কাজ ছেড়ে দিলে তার দেহে আর প্রাণ থাকে না। কাজের মরণ হলে মানুষেরও মরণ হয়। তাই আমিও একজন শ্রমিকের মতো দিনরাত কাজ করি, বরং ওদের চেয়ে বেশি করি।
এখন ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, পটুয়াখালীসহ প্রায় ১৫টি স্থানে আমার আইপিএস ডিলারের মাধ্যমে বিক্রয় হয়। বাজারে যে চাহিদা সেই মতো দিতে পারি না। কারণ, অত পুঁজি আমার নেই। এখন একটা ব্যাটারির কারখানায়ও হাত দিয়েছি। প্রায় ৩০ লাখ টাকায় শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে হেউলিবুনিয়া এলাকায় প্রায় এক একর জমি কিনে সেখানে হাইটেনশন বিদ্যুৎ সংযোগ এবং কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করেছি। এর নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘রহিম ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড সোলার এনার্জি লিমিটেড’।
আমার মনে হয় ব্যবসা কখনো আর্থিক লাভের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়। ব্যবসার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সবাই মিলে ভালো থাকার চেষ্টা। আমি সে লক্ষ্য নিয়েই এখনো কাজ করে যাচ্ছি, এক মুহূর্ত বসে থাকি না। আমি বুঝি আজ যা কিছু আমার হয়েছে, তা এই সদিচ্ছা আর পরিশ্রমের গুণেই হয়েছে। আমি চাই আমার প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণে আসুক। মানুষ উপকৃত হোক। এর মধ্য দিয়ে নিজেকে কিছুটা হলেও মানুষ ভাবতে পারব।
 অনুলিখিত

গাভির খামারে সখিনার দিনবদল

নিতান্ত দরিদ্র একটি পরিবার। টাকার অভাবে ভালো একটি শাড়িও কেনা হয়নি কখনো। হঠাৎ একদিন স্বামী আবদুল মজিদের কাছে একটি গাভি কিনে আনার আবদার করেন সখিনা। একটি গাভি থেকে দুটি। দুটি থেকে চারটি। এভাবে বাড়তে বাড়তে এখন ৮৪টি গরুর মালিক এই দম্পতি। গড়ে তুলেছেন বিশাল দুগ্ধ খামার।
সখিনা-মজিদ দম্পতির বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কাবিলপুর গ্রামে। তাঁদের অভাবের সংসার এখন সুখ আর প্রাচুর্যে ভরপুর। বলতে গেলে শূন্য হাতে শুরু করে আজ তাঁরা সাফল্যের শিখরে উঠেছেন। পরিশ্রম আর সংগ্রাম করে সখিনা শুধু নিজের সংসারেই স্বচ্ছলতা আনেননি, পাশাপাশি গ্রামের অন্যদেরও গাভি পালনে উৎসাহিত করে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। কাবিলপুর থেকে খামার-বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছে সোনাতলা উপজেলার আশপাশের গ্রামগুলোয়।
সখিনা বেগম সোনাতলার জীবনপুর গ্রামের আবদুল করিম শেখের মেয়ে। ১৯৮২ সালে একই উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের আবদুল মজিদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। স্বল্পশিক্ষিত স্বামীর তখন আয়-রোজগার ছিল না। অভাবের কাছে হার মানেননি সখিনা। কিছু একটা করার সংকল্প নিয়ে বাবার দেওয়া সোনার বালা ৫০০ টাকায় বিক্রি করে এ অর্থ তুলে দেন স্বামীর হাতে। স্বামী শুরু করেন হাটে হাটে ধান কেনার ব্যবসা। কয়েক বছর পর সখিনাকে একটি গাভি কিনে দেন মজিদ। সেই একটি গাভিই তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। সখিনা গড়ে তুলেছেন দুগ্ধ খামার। ওই খামারের নাম ‘সখিনা ডেইরি খামার’। ২০০০ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
যেভাবে শুরু: বাইসাইকেলে চড়ে গ্রামের হাটবাজারে গিয়ে ধান ও চালের ব্যবসা করতেন মজিদ। সখিনা একদিন আবদার করলেন, ধান ভাঙার পর তুষ ও চালের কুঁড়া থেকে যায়। একটা গাভি থাকলে এসব খাওয়ানো যেত। মজিদ বলেন, ‘সখিনা বিয়ের পর কোনো কিছুরই আবদার করেনি। এত দিন পর একটা গাভি চেয়েছে। সালটা ১৯৯৮ হবে। পাশের নামাজখালী গ্রামে গিয়ে সুভাষ ঘোষ নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৬ হাজার টাকায় একটি বিদেশি গাভি কিনে বাড়িতে নিয়ে আসি। সেই যে শুরু, তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
দুগ্ধ খামারে একদিন: বগুড়া শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে কাবিলপুর গ্রাম। সখিনার পাকা বাড়ির পাশেই প্রায় ৪০ শতাংশ জায়গাজুড়ে বিশাল দুগ্ধ খামার।
সখিনা জানান, দুধেল গাভির মধ্যে ২০টি ফ্রিজিয়ান, ২০টি শাহিওয়াল ও পাঁচটি জার্সি জাতের। ফ্রিজিয়ান জাতের গাভি ৩০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। দুগ্ধ খামারে কোনো এঁড়ে বাছুর রাখেন না তিনি। দুধ দেওয়া শেষ হলেই তা বিক্রি করে দেন। যে গাভি দিয়ে খামার শুরু করেছিলেন, সেটিও রয়েছে খামারে। সখিনা-মজিদ দম্পতি গাভিটিকে আদর করে ‘লক্ষ্মী’ বলে ডাকেন। খামারের একপাশে বায়োগ্যাস প্লান্ট; অন্যপাশে কয়েক বিঘাজুড়ে লাগানো হয়েছে খামারের গাভির খাবারের জন্য নিপিয়ার ঘাস।
ভাগ্যবদলের উপাখ্যান: সখিনা বলেন, ‘আমাদের এক শতাংশ জমিও ছিল না। প্রথমে খামারের জন্য ৪০ শতাংশ জায়গা কিনেছি। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে খামারে তিনটি শেড দিয়েছি। শেডগুলোর মেঝেতে ইট বিছিয়েছি। পানি সরবরাহের জন্য বৈদ্যুতিক মোটর কিনেছি। প্রতিটি শেডে বৈদ্যুতিক পাখা লাগিয়েছি। খামারের আয় দিয়ে পাঁচ বিঘা আবাদি জমি কিনেছি। আরও পাঁচ বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছি।’
সখিনা আরও জানান, খামারে এখন কোটি টাকার গরু রয়েছে। চালের ব্যবসায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকার পুঁজি খাটছে। বড় ছেলে শাহাদত হোসেন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে মাস্টার্সে পড়ছেন। ছোট ছেলে আজাদ হোসেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে লেখাপড়া করছেন।
আয়-ব্যয়: খামারের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখেন মজিদ। তিনি জানান, বর্তমানে ২৫টি গাভি দুধ দিচ্ছে। এসব গাভি থেকে দিনে গড়ে ৪০০ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দরে। সেই হিসাবে প্রতিদিন দুধ বিক্রি থেকে আয় হয় ১৬ হাজার টাকা। খাদ্য আর শ্রমিকের মজুরি বাবদ খামারে প্রতিদিন ব্যয় প্রায় চার হাজার টাকা। দুধ দোহানোর পর খামারের শ্রমিকেরা তা উপজেলা সদরের ব্র্যাক ডেইরি ও প্রাণের সংগ্রহকেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছেন।
এলাকায় খামার-বিপ্লব: সখিনার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সোনাতলা উপজেলায় অনেকেই দুগ্ধ খামার করেছেন। কাবিলপুরের জাকির হোসেন, আবদুল হামিদ; রানীরপাড়ার পিন্টু মিয়া, শফিকুল ইসলাম; গড়চৈতন্যপুরের লতিফ খলিফা; সোনাতলা বন্দরের সোনা মিয়া, সিরাজুল ইসলামসহ অনেকেই এখন সফল দুগ্ধখামারি। প্রতিদিনই লোকজন আসেন সখিনা-মজিদ দম্পতির কাছে খামার সম্পর্কে নানা পরামর্শ নিতে। এই দম্পতির পরামর্শ নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখন ৬৫টি দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে।
অন্যরা যা বলেন: উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানান, সখিনা-মজিদ দম্পতি ডেইরি খামার গড়ে তোলার মাধ্যমে এলাকার দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণ করছেন। তাঁরা নিজেদের ভাগ্যবদলের পাশাপাশি অন্যদের খামার গড়ার পরামর্শ দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখছেন।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আহসানুল তৈয়ব জাকির বলেন, ‘সখিনা-মজিদ দম্পতিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁদের সংসারে একসময় খুব অভাব-অনটন ছিল। গাভির খামার তাঁদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।’

আরজিনা খাতুন

আরজিনা খাতুন
গ্রামের নারীদের জীবনের দুঃখ মোচন করা
লেখাপড়া করার সৌভাগ্য হয়নি আমার। জন্মের পরই দেখি অভাব আর অভাব। অভাব আমাদের কপালের লিখন। আব্বু দিনমজুরির কাজ করতেন। তাঁর আয় দিয়ে ছয় ভাইবোনের সংসারে দুই বেলা ভাত খাওয়ার অবস্থা ছিল না।

আমার মা মারা যাওয়ার পর পরিবারের লোকজন ১৪ বছর বয়সেই আমাকে বিয়ে দেয় পাশের গ্রামের মমিনুর ইসলামের সঙ্গে। আজও মনে আছে মমিনুরের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা। সেই সব কথা মনে উঠলে চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ে। অনেকেই বলতে লজ্জা পায়, আমি পাই না। আমি স ব সময় সত্য কথা বলার চেষ্টা করি। এতে শরমের কিছু নেই।

বিয়ের সময় স্বামী মমিনুর ১৫ হাজার টাকা যৌতুক চায়, বাবা অনেক কষ্টে ছয় হাজার টাকা দেন। নয় হাজার টাকার জন্য মমিনুর আমাকে নির্যাতন শুরু করে। দুবার আমাকে নির্যাতন করে টাকা আনতে বাবার কাছে পাঠায়। বাবা শুনে কান্নাকাটি করেন। ভাইয়েরা আমার ধার ধারে না। বাবা অনেক বুঝিয়ে আমাকে মমিনুরের কাছে রেখে আসেন। ছয় দিন পর মমিনুর আবার আমাকে নির্যাতন করে। ডান হাত ভেঙে দেয়, দুই দিন উপোস রেখে আমাকে তালাক দেয়। এ অন্যায়ের বিচার কারও কাছে চাইনি।

১৯৯১ সালে বাবা মারা যান। দুই দিন উপোস থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ নিই ধান ভানার। এক বছরে এক হাজার ৭০০ টাকা জমা হয়। এই টাকা দিয়ে দুটি ছাগল, নয়টি মুরগি কিনি। মুরগি ডিম পাড়ে, ছাগল বাচ্চা দেয়, তা বিক্রি করে কিনি একটি গাভি।

একদিন রাতে দেখি, গ্রামের ময়না খাতুনকে তার স্বামী যৌতুকের জন্য নির্যাতন করছে। আমার মতো তারও একটি হাত ভেঙে দিয়েছে। আমি খুবই কষ্ট পাই। ভাবি, ময়নার জন্য যদি কিছু করতে পারতাম। এই ভাবনা থেকে মাথায় আসে সমিতি গঠনের কথা। গ্রামের অভাবী নারীদের নিয়ে বৈঠক করি। সবাইকে বলি, একটি সমিতি করলে উপকার হবে।
২০০২ সালে ৪০ জন নারী নিয়ে গঠন করি পঞ্চায়েত পাড়া শ্রমজীবী নারীর দল। সদস্যদের বোঝাই, আমরা সমাজের বোঝা নই। মুষ্টির চাল জমা করে আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াব। সবাই সাড়া দেয়। সদস্যদের প্রতিদিন রান্না করার আগে এক মুঠো চাল জমা করতে বলি। তারা দিনে এক মুঠো, সপ্তাহে ৭ মুষ্টি করে ৪০ জনের ২৮০ মুষ্টি চাল আমার কাছে জমা দেয়। এ চাল আমি হাটে বিক্রি করি। ৪০ জনের মধ্যে লটারি করে একজনকে চাল বিক্রির টাকা দিয়ে ১০টি হাঁস, ১০টি মুরগি কিনে দিই। পরের সপ্তাহে বাকি ৩৯ জনের মধ্য থেকে একজনকে লটারি করে ২৮০ মুষ্টি চাল বিক্রির টাকায় ১০টি হাঁস, ১০টি মুরগি কিনে দিই। এভাবে ৪০ সপ্তাহে ৪০টি অভাবী সংসার ভরে ওঠে হাঁস, মুরগি, ডিম ও ছানায়।
একটু একটু করে সদস্যদের হাতে আসতে থাকে নগদ টাকা। মুষ্টির চাল বাদ দিয়ে সমিতির তহবিলে জমা নিই সপ্তাহে ৩০ টাকা হারে চাঁদা। আগের মতো লটারি করে ৪০ সপ্তাহে ৪০ জনকেই কিনে দিই একটি করে ছাগল। তৃতীয়বার ৫০ টাকা করে নিয়ে লটারি করে ১৪ হাজার করে টাকা প্রত্যেক সদস্যকে দিই। এ টাকা দিয়ে কেউ জমি বন্ধক নেন, কেউ স্বামীকে ব্যবসার জন্য দেন। বেসরকারি সংস্থা কেয়ারের মাঠকর্মী গোলাম মোস্তফাও সদস্যদের বাড়ির আঙিনায় সবজির বাগান, ঘরের ভেতরে মাশরুম চাষের কৌশল শেখান। একদিন তাঁরা আমাকে নিয়ে যান ভিয়েতনামে। সেখানে শিখি মাশরুম চাষের উন্নত কৌশল। সদস্যরা আমার পরামর্শে মাশরুম ও সবজি চাষ করে বাড়িতে টিনের ঘর তুলেছেন। তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। সমিতির অধীনে ফসলের জন্য কিছু জমি বন্ধক নিয়েছি। দুই বিঘায় একটি পুকুর ইজারা নিয়ে মাছের পোনা ছেড়েছি। আর গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প হাতে নিয়েছি।
ব্র্যাকের সহযোগিতায় পাঁচটি গ্রামের ৩০০ জন নারীকে নিয়ে পল্লিসমাজ নামের একটি সমিতি করেছি। দুটি সমিতির সহযোগিতায় আমি বাল্যবিবাহ, যৌতুক, বিবাহবিচ্ছেদ, নারী নির্যাতন রোধে কাজ করছি। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সামাজিক নারী আন্দোলন জোরালোভাবে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের দেশের বড় সমস্যা জনসংখ্যা। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঠেকাতে নারীদের আরও সচেতন হতে হবে। কারণ, অধিক সন্তানের চাপ পড়ে মায়ের ওপর। আমি সকাল-বিকেল এলাকায় ঘুরি, নারীদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা, জন্মনিয়ন্ত্রণের কুফল সম্পর্কে বোঝাই।
আমাদের দেশে অসহায় নারীর সংখ্যা বেশি। এদের সহযোগিতা করতে সমাজের সচেতন নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামাজিক কুসংস্কার একটি বড় সমস্যা। সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নারীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। নারীকে পেতে হবে মানুষের মর্যাদা। পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা অবহেলিত। তাই নারীর পাশে নারীকেই দাঁড়াতে হবে।
আমি এখনো বুঝি না, ঢাকার এত বড় বড় মানুষ কেন আমাকে সম্মান দেখান। তাঁরাই আমাকে বিদেশে নিলেন। পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করে দিলেন। জানি, এত কিছুর যোগ্য আমি নই। কারণ, এসব পাওয়ার আশায় কিছুই করিনি, যা করেছি বেঁচে থাকার জন্য করেছি। স্বামী তালাক দেওয়ার পর খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছি।
অতীতের কথা এখন মনে করতে চাই না। তা মনে উঠলে দুঃখে মন ভেঙে যায়। শুধু এতটুকু বলি, ভোরে ঘুম থেকে জেগে মাঝ রাত পর্যন্ত আমাকে খাটতে হয়েছে। আর স্বামীর নির্যাতনের কথা মনে হলে শিউরে উঠি। সেই কষ্টের দিনগুলো আমি ভুলে যেতে চাই। আমি এখনো বিয়ে করিনি। বিয়ে করার ইচ্ছাও আমার নেই। আমার ইচ্ছা, কোনো নারী, কোনো শিশু যেন না খেয়ে কষ্ট না পায়। কারণ, ভাতের কষ্ট কী, সেটা আমি জানি। এখন আমার একটাই স্বপ্ন—গ্রামের নারীদের জীবনের দুঃখ মোচন করা। তাদের সংসারে আয়-রোজগার বাড়িয়ে সুখ-শান্তি আনা। জানি না, সেটা কত দূর পারব।

তারিখ: ২৪-১১-২০১২

 অনুলিখিত
 
 
Home, About, Contuct,
Copyright © Careers BD