![]() |
আরজিনা খাতুন |
লেখাপড়া করার সৌভাগ্য হয়নি আমার। জন্মের পরই দেখি অভাব আর অভাব। অভাব আমাদের কপালের লিখন। আব্বু দিনমজুরির কাজ করতেন। তাঁর আয় দিয়ে ছয় ভাইবোনের সংসারে দুই বেলা ভাত খাওয়ার অবস্থা ছিল না।
আমার মা মারা যাওয়ার পর পরিবারের লোকজন ১৪ বছর বয়সেই আমাকে বিয়ে দেয় পাশের গ্রামের মমিনুর ইসলামের সঙ্গে। আজও মনে আছে মমিনুরের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা। সেই সব কথা মনে উঠলে চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ে। অনেকেই বলতে লজ্জা পায়, আমি পাই না। আমি স ব সময় সত্য কথা বলার চেষ্টা করি। এতে শরমের কিছু নেই।
বিয়ের সময় স্বামী মমিনুর ১৫ হাজার টাকা যৌতুক চায়, বাবা অনেক কষ্টে ছয় হাজার টাকা দেন। নয় হাজার টাকার জন্য মমিনুর আমাকে নির্যাতন শুরু করে। দুবার আমাকে নির্যাতন করে টাকা আনতে বাবার কাছে পাঠায়। বাবা শুনে কান্নাকাটি করেন। ভাইয়েরা আমার ধার ধারে না। বাবা অনেক বুঝিয়ে আমাকে মমিনুরের কাছে রেখে আসেন। ছয় দিন পর মমিনুর আবার আমাকে নির্যাতন করে। ডান হাত ভেঙে দেয়, দুই দিন উপোস রেখে আমাকে তালাক দেয়। এ অন্যায়ের বিচার কারও কাছে চাইনি।
১৯৯১ সালে বাবা মারা যান। দুই দিন উপোস থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ নিই ধান ভানার। এক বছরে এক হাজার ৭০০ টাকা জমা হয়। এই টাকা দিয়ে দুটি ছাগল, নয়টি মুরগি কিনি। মুরগি ডিম পাড়ে, ছাগল বাচ্চা দেয়, তা বিক্রি করে কিনি একটি গাভি।
একদিন রাতে দেখি, গ্রামের ময়না খাতুনকে তার স্বামী যৌতুকের জন্য নির্যাতন করছে। আমার মতো তারও একটি হাত ভেঙে দিয়েছে। আমি খুবই কষ্ট পাই। ভাবি, ময়নার জন্য যদি কিছু করতে পারতাম। এই ভাবনা থেকে মাথায় আসে সমিতি গঠনের কথা। গ্রামের অভাবী নারীদের নিয়ে বৈঠক করি। সবাইকে বলি, একটি সমিতি করলে উপকার হবে।
২০০২ সালে ৪০ জন নারী নিয়ে গঠন করি পঞ্চায়েত পাড়া শ্রমজীবী নারীর দল। সদস্যদের বোঝাই, আমরা সমাজের বোঝা নই। মুষ্টির চাল জমা করে আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াব। সবাই সাড়া দেয়। সদস্যদের প্রতিদিন রান্না করার আগে এক মুঠো চাল জমা করতে বলি। তারা দিনে এক মুঠো, সপ্তাহে ৭ মুষ্টি করে ৪০ জনের ২৮০ মুষ্টি চাল আমার কাছে জমা দেয়। এ চাল আমি হাটে বিক্রি করি। ৪০ জনের মধ্যে লটারি করে একজনকে চাল বিক্রির টাকা দিয়ে ১০টি হাঁস, ১০টি মুরগি কিনে দিই। পরের সপ্তাহে বাকি ৩৯ জনের মধ্য থেকে একজনকে লটারি করে ২৮০ মুষ্টি চাল বিক্রির টাকায় ১০টি হাঁস, ১০টি মুরগি কিনে দিই। এভাবে ৪০ সপ্তাহে ৪০টি অভাবী সংসার ভরে ওঠে হাঁস, মুরগি, ডিম ও ছানায়।
একটু একটু করে সদস্যদের হাতে আসতে থাকে নগদ টাকা। মুষ্টির চাল বাদ দিয়ে সমিতির তহবিলে জমা নিই সপ্তাহে ৩০ টাকা হারে চাঁদা। আগের মতো লটারি করে ৪০ সপ্তাহে ৪০ জনকেই কিনে দিই একটি করে ছাগল। তৃতীয়বার ৫০ টাকা করে নিয়ে লটারি করে ১৪ হাজার করে টাকা প্রত্যেক সদস্যকে দিই। এ টাকা দিয়ে কেউ জমি বন্ধক নেন, কেউ স্বামীকে ব্যবসার জন্য দেন। বেসরকারি সংস্থা কেয়ারের মাঠকর্মী গোলাম মোস্তফাও সদস্যদের বাড়ির আঙিনায় সবজির বাগান, ঘরের ভেতরে মাশরুম চাষের কৌশল শেখান। একদিন তাঁরা আমাকে নিয়ে যান ভিয়েতনামে। সেখানে শিখি মাশরুম চাষের উন্নত কৌশল। সদস্যরা আমার পরামর্শে মাশরুম ও সবজি চাষ করে বাড়িতে টিনের ঘর তুলেছেন। তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। সমিতির অধীনে ফসলের জন্য কিছু জমি বন্ধক নিয়েছি। দুই বিঘায় একটি পুকুর ইজারা নিয়ে মাছের পোনা ছেড়েছি। আর গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প হাতে নিয়েছি।
ব্র্যাকের সহযোগিতায় পাঁচটি গ্রামের ৩০০ জন নারীকে নিয়ে পল্লিসমাজ নামের একটি সমিতি করেছি। দুটি সমিতির সহযোগিতায় আমি বাল্যবিবাহ, যৌতুক, বিবাহবিচ্ছেদ, নারী নির্যাতন রোধে কাজ করছি। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সামাজিক নারী আন্দোলন জোরালোভাবে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের দেশের বড় সমস্যা জনসংখ্যা। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঠেকাতে নারীদের আরও সচেতন হতে হবে। কারণ, অধিক সন্তানের চাপ পড়ে মায়ের ওপর। আমি সকাল-বিকেল এলাকায় ঘুরি, নারীদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা, জন্মনিয়ন্ত্রণের কুফল সম্পর্কে বোঝাই।
আমাদের দেশে অসহায় নারীর সংখ্যা বেশি। এদের সহযোগিতা করতে সমাজের সচেতন নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামাজিক কুসংস্কার একটি বড় সমস্যা। সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নারীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। নারীকে পেতে হবে মানুষের মর্যাদা। পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা অবহেলিত। তাই নারীর পাশে নারীকেই দাঁড়াতে হবে।
আমি এখনো বুঝি না, ঢাকার এত বড় বড় মানুষ কেন আমাকে সম্মান দেখান। তাঁরাই আমাকে বিদেশে নিলেন। পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করে দিলেন। জানি, এত কিছুর যোগ্য আমি নই। কারণ, এসব পাওয়ার আশায় কিছুই করিনি, যা করেছি বেঁচে থাকার জন্য করেছি। স্বামী তালাক দেওয়ার পর খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছি।
অতীতের কথা এখন মনে করতে চাই না। তা মনে উঠলে দুঃখে মন ভেঙে যায়। শুধু এতটুকু বলি, ভোরে ঘুম থেকে জেগে মাঝ রাত পর্যন্ত আমাকে খাটতে হয়েছে। আর স্বামীর নির্যাতনের কথা মনে হলে শিউরে উঠি। সেই কষ্টের দিনগুলো আমি ভুলে যেতে চাই। আমি এখনো বিয়ে করিনি। বিয়ে করার ইচ্ছাও আমার নেই। আমার ইচ্ছা, কোনো নারী, কোনো শিশু যেন না খেয়ে কষ্ট না পায়। কারণ, ভাতের কষ্ট কী, সেটা আমি জানি। এখন আমার একটাই স্বপ্ন—গ্রামের নারীদের জীবনের দুঃখ মোচন করা। তাদের সংসারে আয়-রোজগার বাড়িয়ে সুখ-শান্তি আনা। জানি না, সেটা কত দূর পারব।
তারিখ: ২৪-১১-২০১২
অনুলিখিত