![]() |
নিলুফার ইয়াসমিন |
২৮ বছর আগে নাজিরপুর উপজেলার কলার দোয়ানিয়া এলাকা থেকে স্বরূপকাঠি উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের বিন্না গ্রামে বউ হয়ে আসি। বিয়ের এক বছর পর আমার স্বামী আবুল কালাম আমাকে বিন্না গ্রামের বাড়িতে রেখে কাজের খোঁজে ঢাকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে স্টেডিয়াম এলাকায় একটি ক্যারম বোর্ড, শিল্ড তৈরি কারখানায় (দোকানের নাম খেলার সাথী) কাজ নেন। যেখানে জুটত তিন বেলা খাবার আর মাস শেষে ১০০ টাকা ও থাকার ব্যবস্থা। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে এসে আমার স্বামী বলতেন তাঁর দুরবস্থার কথা। সব সময় চিন্তা করতেন, ‘অভাবী পরিবার আমাদের, সামনে কীভাবে আমরা চলব।’
সময় গড়াতে থাকে, এরই মাঝে আমাদের সংসারে দুই সন্তান আসে। ওই কারখানায় কয়েক বছর কাজ করার পর আমার স্বামী আবুল কালামের বেতন ৫০০ টাকা দাঁড়ায়। কারখানায় কাজ করার সময় একদিন পাশের দোকানে একটি ক্রিকেট ব্যাট দেখেন আমার স্বামী। স্থানীয় কাঠ দিয়ে সে রকম একটি ব্যাট তৈরি করে ফেলেন তিনি। কারখানার মালিক আমার স্বামীকে এ ব্যাটের আদলে কয়েকটি ব্যাট তৈরি করে দিতে বললে তিনি স্থানীয় কাঠ দিয়ে প্রায় ৮০টি ব্যাট তৈরি করে ফেলেন।
২১ বছর আগের কথা। আমার স্বামী একদিন ঢাকা থেকে বাড়িতে এসে আমাকে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কথা জানান, আমি তখন তাঁকে বলি এখন তো ৫০০ টাকা পাও, ব্যাট তৈরি করতে গিয়ে সবকিছু যেন খোয়া না যায়। কাজপাগল আমার স্বামী আমাদের বাগানে থাকা নারকেল-সুপারি বিক্রি করে সাত হাজার টাকা সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন লোকের বাগান থেকে কদম, চাম্বল, মেহগনিসহ বিভিন্ন কাঠ কিনে আনেন। এরপর এ কাঠগুলো মিল থেকে চেরাই করে আনেন। সঙ্গে কাঠ ছাঁচা-মাটার জন্য রানদা, হাতুড়ি, বাটাল, কুঠার ও আইকা গাম কিনে আনেন।
আমরা দুজন মিলে কাঠগুলো কুঠার দিয়ে কুপিয়ে সাইজ করে রানদা দিয়ে ছাঁচি এবং বাড়ির উঠানে রোদে কাঠগুলো শুকাতে দিই। প্রায় এক মাস ধরে এ কাঠগুলো শুকানোর পর প্রতিটির ‘ভি’ কাটি (যেখানে হাতল জোড়া লাগানো হয়)। হাতল জোড়া দেওয়ার পর ওপর ও নিচের অংশ কেটে ফেলি। এরপর কুঠার দিয়ে আস্তে আস্তে কোপাই এবং সবশেষে রানদা দিই ও হাতলের জোড়া মুখে ফাইল ঘষি।
কাঠ শুকানোর এক মাস পর সেই কাঠে একটি ব্যাট তৈরি করতে ১৫ মিনিট সময় লাগে। একটি ব্যাট তৈরিতে নয় বার হাত লাগাতে হয়। আমরা দুজনে মিলে ৮০০ ব্যাট তৈরি করে প্রথম চালান ঢাকায় পাঠাই। শূন্য থেকে বড় সাইজের এ ব্যাটগুলো ঢাকায় পাইকারি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা পাই। খরচ বাদ দিয়ে প্রথম দফায় আমাদের লাভ হয় ৩০ হাজার টাকা। আমাদের তৈরি করা ব্যাটের চাহিদা বাড়ার পর আমাদের কারখানায় ধীরে ধীরে লোকবল বাড়াই। যা একসময় ১৫-১৬ জনে দাঁড়ায় এবং ব্যাট তৈরির কাজের জন্য কিছু স্থায়ী মেশিনপত্র কিনি।
২০০১ সালের দিকে ঢাকার মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে দেওয়া ক্রিকেট ব্যাটের দাম বাকি পড়ার কারণে আমাদের পুঁজির সংকট দেখা দেয়। এ সময় ‘পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র’ নামে একটি এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ নিই। ২০০৫ সালের দিকে আমি সফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে সিটি গ্রুপ পুরস্কার লাভ করি এবং ঢাকার হোটেল শেরাটনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণ করি। এ সময় প্রথম আলো থেকে একটি মোবাইল ফোন ও এক হাজার টাকা এবং চ্যানেল আই থেকে তিন হাজার টাকা ও একটি টাঙ্গাইলের শাড়ি আমাকে দেওয়া হয়।
প্রথম আলোতে আমাদের তৈরি ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর আমাদের বাড়িতে সাংবাদিকদের আসা-যাওয়া বেড়ে যায়। আমাদের তৈরি ব্যাটের চাহিদা দেখে আমাদের গ্রাম বিন্নাসহ নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে প্রায় ২০০ কারখানা গড়ে উঠেছে। ২০০০ সালে আমি সিটি গ্রুপের সহায়তায় কানাডার হেলিফ্যাক্স শহর ঘুরে এসেছি। সেখানে আমাদের সঙ্গে নোবেল বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ইউনূস স্যারও ছিলেন। বিন্না গ্রামের বাড়ি থেকে স্বরূপকাঠি উপজেলা সদরেও খুব বেশি যাওয়া হয়নি। আর মেয়ে একবার অসুস্থ হওয়ার কারণে ঢাকা গিয়েছিলাম তাকে ডাক্তার দেখাতে, আমার স্বামী যখন ঢাকায় কাজ করত। ছেলে রিয়াদুল ইসলাম বর্তমানে আলাদা কারখানা গড়ে তুলেছে আর মেয়ে লাইলীকে বিয়ে দিয়ে জামাইকেও ব্যাট তৈরির কাজ শিখিয়ে দিয়েছি।
বিদেশে যাব, প্লেনে চড়তে হবে, ভয়ে ছিলাম যদি প্লেনে উঠতে গেলে পড়ে যাই! অবশ্য প্লেন থেকে পড়ে যাইনি, সুস্থভাবেই কানাডা থেকে ফিরে এসেছি। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে প্রথম আলোর লেখার কারণে। আমাদের কারখানাও সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আজ আমি সফল ব্যবসায়ী। অভাব দূরে সরে গেছে। নিজেদের আয় থেকে আট কাঠা জমি কিনেছি, তাতে একটি ঘরও তৈরি করেছি। প্রথম আলো আরও সামনে এগোবে, আর আমার মতো অজ পাড়াগাঁয়ের এ রকম নিলুফার ইয়াসমিনদের সাফল্যের কথা পত্রিকার মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে ধরবে, এ আশা আমার।
অনুলিখিত