চাই সদিচ্ছা আর পরিশ্রম
১৯৯৪ সালের কথা। ওই বছর বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময় ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে টিভি মেরামতের কাজে খুব ব্যাঘাত ঘটে। এই সময় আমার মাথায় ঘুরপাক খায় বিকল্প পন্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি। শেষ পর্যন্ত আমি আইপিএস বানানোর চেষ্টায় কাজ শুরু করি। ঢাকা, বরিশাল ও কলকাতা থেকে এ-বিষয়ক কারিগরি নানা ধরনের বইপত্র এনে বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটতে থাকি। দিন-রাত এ কাজে সময় দিয়ে আমার মেকানিকের কাজ লাটে ওঠে। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাল কেনার মতো ক্ষমতাও ছিল না।
![]() |
আবদুর রহিম |
এরই মধ্যে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে ধার-দেনা ও সুদে অনেক টাকা এনে পরীক্ষামূলক আইপিএস বানানোর কাজে তা ব্যয় করি। ধার-দেনায় জড়িয়ে আমার নিঃশেষ হওয়ার অবস্থা। তবু এই নেশা আমার যায় না। একদিন আমার স্ত্রী একমাত্র সন্তানকে নিয়ে রাগে-দুঃখে আমাকে ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যায়। আমি তখন আরও অসহায় হয়ে পড়ি। কিন্তু নেশাটা আমায় ছাড়ে না। এভাবে নয় মাস চেষ্টার পর একটা আইপিএস বানিয়েও ফেলি। কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি। আবার চেষ্টা করি, আবার ব্যর্থ হই—এভাবে করতে করতে দুই বছর পর আমার চেষ্টা কিছুটা সার্থক হয়। সাত বছর চেষ্টার পর তা আরও পূর্ণতা পায় এবং ২০০১ সালে প্রথম বাজারে পরীক্ষামূলক দুটি আইপিএস বিক্রি করি। আর এখন আমার প্রযুক্তির আইপিএস দেশের সর্বত্র বাজারজাত হচ্ছে। দেশের বাজারে বর্তমানে সবচেয়ে কম মূল্যে বিক্রি হচ্ছে এবং সবচেয়ে বেশি সময় ব্যাকআপ (চার ঘণ্টা) দিচ্ছে।
আমি ছিলাম সাধারণ এক রেডিও-টিভি মেকানিক। বরগুনায় বাড়ি। মক্তবে লেখাপড়ার পর সংসারের হাল ধরতে হয় আমার। তাই আর লেখাপড়া করতে পারিনি। কিন্তু আমি দমে যাইনি। নতুন কিছু একটা করার চেষ্টা ছিল সব সময়। তরুণদের উদ্ভাবনী ক্ষমতায় আমার বিশ্বাস আছে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। আমার তৈরি আইপিএসের গুণগত মান উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি। যাঁরা আমার আইপিএস ব্যবহার করেন, তাঁদের কম্পিউটার চালাতে আলাদা ইউপিএস দরকার হয় না। সম্প্রতি আমার আইপিএসে যোগ করা হয়েছে সোলার প্রযুক্তি। নিম্ন আয়ের মানুষেরা যাতে বিদ্যুতের সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা মূল্যের সোলার-সংবলিত আইপিএস তৈরি করেছি। এখন বিদ্যুৎ নেই এমন গ্রামেও উদ্ভাবিত এই আইপিএস ব্যবহার করা যাচ্ছে।
২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম আলো আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য ব্যক্তি ফোন করে আমার কাজের প্রশংসা করেন। প্রথম আলো আমাকে দেশে এমনকি বিদেশেও পরিচয় করিয়ে দেয়। ওই খবর আমার কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দেয়, পাশাপাশি ঘুরিয়ে দেয় জীবনের মোড়।
আমি লেখাপড়া জানি না, কিন্তু মানুষ আমাকে ভালোবাসে, সম্মান দেয়; এর চেয়ে জীবনে বড় পাওয়া আর কী থাকতে পারে। তবে অর্থ আর সম্মানের আশায় আমি কাজ করি না। এই দেশটাকে আলোকিত করাই হলো আমার স্বপ্ন। আমাদের শ্রমশক্তি ও বুদ্ধি আছে। এখন বিদ্যুতের অভাব দূর করা গেলে এই দেশের অগ্রগতি কেউ ঠেকাতে পারবে না।
দিন-রাত খাটাখাটুনির মধ্যেও কেবল ভাবি, কীভাবে আমার এই প্রযুক্তি আরও উন্নত করা যায়। কারণ, প্রযুক্তি বিষয়টা এমন যে এটা দিন দিন সামনে এগিয়ে যায়। আমার শুধু চিন্তা হয়, এটুকু করে যদি আমি বসে থাকি তবে পেছনে পড়ে যাব। এই চিন্তাটা আগে আমার হতো না, প্রথম আলো আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশ-বিদেশ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়ে এই সংশয়টা আমাকে তাড়া করতে থাকে। কারণ, নিজেই জানতাম না আমি কী কাজ করেছি। প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ অনেক প্রকৌশলী প্রথম আলোর প্রতিবেদন পড়ে আমার বানানো আইপিএস ও এর সার্কিট পরীক্ষা চালিয়ে বললেন, এটা আসলেই সেরা। তখন থেকেই এই চিন্তাটা আমাকে আরও বেশি করে চেপে ধরে।
দেশের বাজারে যে আইপিএস পাওয়া যায়, সেগুলো দুই ঘণ্টার বেশি ব্যাকআপ দেয় না। দেশে-বিদেশে তৈরি ১০০০ ভিএ (ভোল্ট-অ্যাম্পিয়ার) ক্ষমতাসম্পন্ন একটি আইপিএসে যেখানে ১২ ভোল্টের দুটি ব্যাটারি লাগে, সেখানে আমার আইপিএসে ব্যাটারি লাগে মাত্র একটি। কিন্তু অন্যরাও হয়তো একটা ব্যাটারি ও চার ঘণ্টা ব্যাকআপ দেয় এমন আইপিএস বানিয়ে ফেলবে, সেদিন বেশি দূরে নয়। তখন আমার আইপিএসের তো কোনো বিশেষ গুণ থাকবে না। সেই চিন্তা আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। দুই বছর ধরে ভেবে এখন অবশ্য একটা বুদ্ধি বের করে ফেলেছি। বুদ্ধিটা হলো আইপিএসের সঙ্গে সোলার প্যানেল সংযোজন। এরই মধ্যে বরগুনার কয়েকটি গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে ২০টির মতো আইপিএসে সোলার প্যানেল সংযোজন করে দিয়েছি এবং তারা সার্বক্ষণিক সূর্যের আলো দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারছে। এতে যেমন ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার কোনো চিন্তা নেই, তেমনি ব্যাকআপ নিয়েও দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
সোলার প্যানেল দিয়ে যেখানে শুধু অল্প আলোর কয়েকটা বাতি ছাড়া অন্য কোনো কিছু চালানো যেত না, এখন তাতে ফ্যান, রঙিন টিভি, ছোট্ট মোটর, কম্পিউটার, ড্রিল মেশিন, প্রিন্টার চালানো যাচ্ছে। গ্রামের মানুষেরা এটা দিয়ে কম্পিউটার চালিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।
গরিব মানুষের তো আইপিএস ব্যবহারের সুযোগ নেই। এসব বিবেচনায় এনে সম্প্রতি মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় সোলার প্যানেল সংযোজিত একটি আইপিএস বাজারজাত করেছি। এতে চার ঘণ্টা অনায়াসে চারটি বাতি জ্বলবে। এক হাজার ৫০০ টাকায় দুটি বাতি জ্বলবে এমন আরেকটি আইপিএসও বাজারে ছেড়েছি। এর ফলে প্রত্যন্ত গ্রামেও সহজে এই আইপিএস ব্যবহার করা যাবে। সূর্যের আলো ব্যবহার করে আইপিএস চালাতে পারলে এবং কম দামে তা দিতে পারলে মানুষের অনেক উপকারে আসবে। এটা ব্যাপক হারে করতে পারলে গ্রামের মানুষ নিজস্ব আলো ব্যবহার করে আলোকিত হতে পারবে।
২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে বরগুনার বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায় এক মাস বিচ্ছিন্ন ছিল। তখন দেশ-বিদেশের সব ধরনের খবরাখবর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এ জেলার মানুষ। ওই সময় শহরের সিদ্দিক স্মৃতিমঞ্চে বড় পর্দা লাগিয়ে আইপিএস দিয়ে প্রতিদিন রাতে টিভি দেখানোর ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখেছি খবরের জন্য মানুষের কী ব্যাকুলতা। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দলে দলে খবর দেখতে এখানে ভিড় করত। এখনো সামান্য ঝড়-বৃষ্টি হলে বরগুনার নাজুক বিদ্যুৎ সরবরাহ দু-তিন দিন বিচ্ছিন্ন থাকে। তখন মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। কিন্তু এখন এই দুর্ভোগ অনেক ঘুচিয়ে দিয়েছে আইপিএস। মানুষের এই দুর্ভোগ লাঘবে আমার মতো সামান্য একজন মানুষের প্রচেষ্টা কাজে লাগবে, এটা কখনো ভাবিনি।
বর্তমানে আমার কারখানায় ও বাজারজাতের কাজে ৭০-৭৫ জন লোক কাজ করে। ছয়-সাত বছর আগে যা শুরু করেছিলাম আমি একাই। কারখানায় আমার যেসব সহকর্মী, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা মালিক-শ্রমিকের নয়। আমি এখনো ওদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি। কারণ, কারখানাটা আমার সন্তানের মতো। আর কাজ হলো আমার পরম ইবাদত। আমি জানি, কাজের লোকেরা কাজ ছেড়ে দিলে তার দেহে আর প্রাণ থাকে না। কাজের মরণ হলে মানুষেরও মরণ হয়। তাই আমিও একজন শ্রমিকের মতো দিনরাত কাজ করি, বরং ওদের চেয়ে বেশি করি।
এখন ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, পটুয়াখালীসহ প্রায় ১৫টি স্থানে আমার আইপিএস ডিলারের মাধ্যমে বিক্রয় হয়। বাজারে যে চাহিদা সেই মতো দিতে পারি না। কারণ, অত পুঁজি আমার নেই। এখন একটা ব্যাটারির কারখানায়ও হাত দিয়েছি। প্রায় ৩০ লাখ টাকায় শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে হেউলিবুনিয়া এলাকায় প্রায় এক একর জমি কিনে সেখানে হাইটেনশন বিদ্যুৎ সংযোগ এবং কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করেছি। এর নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘রহিম ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড সোলার এনার্জি লিমিটেড’।
আমার মনে হয় ব্যবসা কখনো আর্থিক লাভের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়। ব্যবসার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সবাই মিলে ভালো থাকার চেষ্টা। আমি সে লক্ষ্য নিয়েই এখনো কাজ করে যাচ্ছি, এক মুহূর্ত বসে থাকি না। আমি বুঝি আজ যা কিছু আমার হয়েছে, তা এই সদিচ্ছা আর পরিশ্রমের গুণেই হয়েছে। আমি চাই আমার প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণে আসুক। মানুষ উপকৃত হোক। এর মধ্য দিয়ে নিজেকে কিছুটা হলেও মানুষ ভাবতে পারব।
অনুলিখিত