প্রদীপ সরকার

প্রদীপ সরকার
আইসক্রিমের কাঠি আমার সাফল্যের চাবিকাঠি
বাবা-মা ও ছোট বোনকে নিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার। ছয় বছর হলো বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট বোন শম্পা উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছে। নিজেদের জায়গা-জমি বলতে গেলে কম নেই। সাত-আট বিঘা হবে। তার পরও সংসার ভালোভাবে চলে না। অভাব লেগেই থাকত। আমাদের এলাকাটা নিচু। বর্ষায় মাঠ-ঘাট তলিয়ে যায়। মাঠে ফসল হয় না। বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করি আর পাশাপাশি পড়ালেখা। কোনো দিন স্কুলে যাই, আবার কোনো দিন স্কুলে যাওয়া হয় না।

১০-১১ বছর আগে বাবা ভারতে এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যান। সেখানে গিয়ে আইসক্রিমের কাঠি তৈরির একটি কারখানা দেখেন। খোঁজ নেন কারখানাটি করতে কত খরচ পড়েছে, লাভ কেমন। ঘর থাকলে কারখানা করতে পাঁচ-ছয় লাখ টাকার মতো লাগে। বাবা বাড়ি ফিরে মা ও আমাকে এসব বললেন। সংসারের অভাব ঘোচাতে আইসক্রিমের কাঠি তৈরির একটি কারখানা করার কথা ভাবি। কিন্তু টাকার অভাবে ওই যাত্রায় আর কারখানা করা হয়ে ওঠেনি। তবে চিন্তাটা মাথায় রয়ে যায়।
২০০৫ সালের কথা। স্থানীয় স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছি। ভর্তি হলাম সিংড়া বিহারীলাল কলেজে। মাঠের কাজ আর কলেজের ক্লাস—সবকিছুর মধ্যে ওই কারখানা গড়ার স্বপ্ন উঁকি দিত। এইচএসসি পাস করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিতে থাকলাম। কিন্তু কোথাও সুযোগ পেলাম না। বাবাকে বললাম, এ বছর হলো না, আগামী বছর ভর্তি হব। এ সময়ে যেকোনোভাবেই হোক টাকা জোগাড় করে আইসক্রিমের কাঠি তৈরির কারখানা করতে হবে। কিছু জমি বন্ধক রেখে পেলাম এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা, আশা এনজিও থেকে ৭৫ হাজার, কৃষি ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার, জনতা ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার টাকা এভাবে নানা জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করলাম। ভারতের তৈরি কাঠি কাটা, পাতা তোলা, ফিনিশিং মেশিন, মেশিন চালানোর জন্য তিনটি ডিজেল ইঞ্জিন কিনে আনলাম। রাস্তার পাশে নিজেদের জায়গায় বড় করে কারখানার জন্য ঘর তুললাম। এভাবে একটা একটা করে প্রায় দুই বছর ধরে ২০০৭ সালের শেষ দিকে কারখানার কাজ শেষ হলো। তিনজন শ্রমিক আর বাবা, মা, বোনকে নিয়ে পরের বছর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎপাদন শুরু করি।
আইসক্রিমের কাঠি তৈরিতে নরম জাতের সাধারণ কাঠ যেমন লাটিম, ভেটুল, কদম, আমড়া, ছাতিমজাতীয় কাঠ লাগে। এসব কাঠের দামও খুব কম। প্রথম দিকে আমি আর বাবা গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাঠ কিনে আনতাম। এখন কাঠ ব্যবসায়ীরা কারখানায় কাঠ পৌঁছে দেন। এক ঘনফুট (সিএফটি) কাঠের দাম ১৬০-১৭০ টাকা। প্রতিদিন কারখানায় ৩৫-৪০ সিএফটি কাঠ লাগে। ডিজেল লাগে ১৬-১৮ লিটার। কারখানায় দুই রকম কাঠি তৈরি হয়। ছোট ও বড়। ছোট কাঠি ২৫-৩০ টাকা বান্ডিল (এক বান্ডিলে এক হাজার কাঠি থাকে)। বড় কাঠি ৩০-৩৫ টাকা বিক্রি হয়। কাঠি বিক্রির বড় মোকাম ঢাকার যাত্রাবাড়ী। এ ছাড়া মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ীতেও কাঠি বিক্রি হয়। আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মালিকেরা কাঠি কিনে নিয়ে যান। ঢাকায় না গিয়েও মহাজনদের কাছে কাঠি পাঠালে তাঁরা বিক্রি করে টাকা পাঠিয়ে দেন। কাঠি তৈরি করার প্রক্রিয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি বের হয়। এ ছাড়া কাঠি বান্ডিল করার সময়ও প্রচুর কাঠি বাছাইয়ে বাদ পড়ে। এগুলো স্থানীয়ভাবে জ্বালানির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কারখানা থেকে কম দামে এগুলো বিক্রি করা হয়।
আমাদের তালখড়ি ও আশপাশের গ্রামের মানুষ খুব অভাবী। বেশির ভাগ মানুষ গরিব, দিনমজুর, ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষি। নিচু এলাকা হওয়ায় বর্ষায় মাঠ-ঘাট এমনকি বাড়িঘর পর্যন্ত তলিয়ে যায়। পানি নামার পথ না থাকায় জলাবদ্ধতা অনেক দিন স্থায়ী হয়। মাঠে ফসল ফলে না। এ সময় নারী-পুরুষ কারও কোনো কাজ থাকে না। বিশেষ করে নারীরা একেবারেই অলস সময় কাটান। আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী। নারীদের কাজের বাইরে রেখে সমাজ বা দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি অসম্ভব। এ জন্য আমি কাঠি বাঁধার কাজে কেবল নারীদের সম্পৃক্ত করেছি। তাঁদের স্বাবলম্বী ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছি। তাঁরা সংসারের কাজের ফাঁকে অবসরে কাঠি বাঁধার কাজ করেন। স্কুল থেকে এসে শিশুরাও কাঠি বাঁধে। তাদের আয়ে তারা পড়ার খরচ চালায়। এমন বহু পরিবার আছে, যাদের কাঠি বাঁধার টাকা দিয়ে জীবন-জীবিকা চলে। দুই বেলা দুই মুঠো ভাত খাচ্ছে। শিশুরা পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছে। অনেকে কাঠি বাঁধার টাকা জমিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। অভাব যাঁদের নিত্যসঙ্গী ছিল, তাঁরা ধীরে ধীরে সচ্ছল হয়ে উঠছেন। আমি এখন বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, মাত্র চার বছরে আমার কারখানায় কাঠি বাঁধার কাজ করে এখানকার অসচ্ছল মানুষগুলো এখন সচ্ছল হয়েছেন। কেউ আর না খেয়ে থাকেন না। এ কথা ভাবতেই গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে।
কাঠি বাঁধার জন্য ৬৫ জন তালিকাভুক্ত নারী রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত কাঠি বাঁধেন। গরমের মৌসুমে এ সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। এসব নারীর সঙ্গে তাঁদের পরিবারের অন্য নারী-শিশু ও বৃদ্ধরাও কাজ করেন। অসচ্ছলদের পাশাপাশি সচ্ছল নারীরাও অবসরে কাঠি বেঁধে বাড়তি আয় করছেন। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ জন কাঠি বাঁধেন। এক হাজার কাঠি একত্র করে গুছিয়ে বাঁধতে পাঁচ-সাত মিনিট সময় লাগে। এ জন্য পারিশ্রমিক দেওয়া হয় এক টাকা। একজন নারী গড়ে প্রতি মাসে সংসারের কাজের ফাঁকে কাঠি বেঁধে ন্যূনতম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় করেন। শীতের মৌসুমে নারী-শিশুরা মহানন্দে উৎসবের আমেজে প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ আঁটি বা বান্ডিল বাঁধতে পারে। মাস শেষে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। গ্রামের প্রতিটি ঘরে বান্ডিল বাঁধার জন্য বিশাল বিশাল স্তূপ করে কাঠি রাখা হয়। কারখানা থেকে শ্রমিক দিয়ে বাড়ি বাড়ি ওই কাঠি পৌঁছে দেওয়া হয়। কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ মাসে বাজারে কাঠির চাহিদা কম থাকে। তার পরও বছরের ৩৬৫ দিনই কাঠি বাঁধার কাজ চলে। শীতের সময় উৎপাদিত কাঠি মজুত করে রাখা হয়। কারখানায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধকোটি পিস কাঠি তৈরি হয়।
কাঠি তৈরির কারখানা করে আমার জীবন-জগৎ পাল্টে গেছে। সবাই প্রশংসা করেন। উৎসাহ দেন। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তবে মানুষের কল্যাণে কিছু একটা করতে পেরেছি বলে শান্তি পাই। সব কষ্ট ভুলে যাই। মাগুরা সরকারি হোসেন শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দী কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ছি। এখন তৃতীয় বর্ষে। ক্লাস বা প্রাইভেট পড়া থাকলে সকালে ঘুম থেকে উঠে কলেজে যাই। কারখানা ছাড়াও খেত-খামার করি। তাই কলেজ থেকে ফিরে মাঠে বা কারখানায় কাজে নেমে পড়ি। প্রতিদিন রাত তিনটার দিকে উঠে কারখানার মেশিন চালাই। দিনের চেয়ে রাতে কারখানায় কাজ করা সুবিধা। কাঠ থেকে মেশিনে রোল করা, কাঠি কাটা, ফিনিশিং আরও অনেক কাজ। নিজে না থাকলে কর্মচারীদের দিয়ে কাজ হয় না। নয়জন কর্মচারী আছেন। পেরে উঠছি না। তাই ভাবছি আরও কয়েকজনকে নিয়োগ দেব। তবে অবশ্যই তাঁরা হবেন এলাকার বেকার যুবক।
আসলে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকা, সুখে থাকার আনন্দই আলাদা। একা ভালো থেকে কোনো লাভ নেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিকা নিয়ে একটু একটু করে সমাজকে পাল্টাতে হবে। কথা বলা, বসে থাকার সময় নেই। কাজ করতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমার গর্বে বুক ভরে যায় যখন ভাবি, আমি খুবই ক্ষুদ্র একটা মানুষ, তার পরও কিছুটা হলেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। খুব গভীরভাবে যখন ভাবি, চোখে জল চলে আসে। যাঁদের দুই বেলা দুই মুঠো খাবার জুটত না, তাঁরা আমার কারখানায় কাজ করে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে। এই সুখানুভূতি বোঝাতে পারব না।
দারিদ্র্য কী আমি জানি। পরিশ্রম আমাকে এখানে এনেছে। তাই আমি কারখানার লাভের দিকে বেশি না তাকিয়ে কারখানায় যাঁরা কাঠি বাঁধার কাজ করেন, তাঁদের মুখের দিকে তাকাই। আমি সততার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। সফল হবই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দারিদ্র্যপীড়িত এ অঞ্চলকে আমি একদিন বদলে দেব।
সত্যি কথা বলতে কি, আমার এ স্বপ্নযাত্রায় সঙ্গী প্রথম আলো। আমার কারখানা নিয়ে প্রথম আলোয় এ বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর আমার জীবন-জগৎ পাল্টে গেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসেছেন। পরামর্শ নিচ্ছেন। মাগুরার বাইরে কয়েক জায়গায় গিয়েছি পরামর্শ দিতে। এলাকার মানুষও কারখানা করার কথা ভাবছেন। এতে আমার কোনো ঈর্ষা নেই। আমি সানন্দে সবাইকে পরামর্শ দিই। সবাই হাত না লাগালে দেশ উঠবে না। ভাবতে পারিনি প্রথম আলোর প্রতিবেদন এমন সাড়া ফেলবে।
প্রথম আলোর কাছে আমি ঋণী। মানুষ নিরাশা বা হতাশার খবর শুনতে শুনতে অস্থির। প্রথম আলোর এমন উদ্যোগ মানুষকে আশাবাদী করবে। প্রথম আলো আমার আত্মবিশ্বাস কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, এমন খবর পড়ে অনেকে স্বপ্ন দেখবেন, স্বপ্ন গড়বেন। কেউ কেউ সফলও হবেন। প্রথম আলোর কাছে আমার প্রত্যাশা, দেশের আনাচকানাচে যাঁরা আমার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়েছেন, কাজ করছেন, খুঁজে বের করে তাঁদের কথা পত্রিকার পাতায় তুলে ধরবে। আমরা একদিন সফল হবই। এ দেশ পিছিয়ে থাকবে না। মানুষ বদলে যাবে। আমরাই দেশকে বদলে দেব।
 অনুলিখিত
 
 
Home, About, Contuct,
Copyright © Careers BD